
একদিন বিকেলে হন্তদন্ত সাব বাড়ির উঠান থেকে 'মা মা' চিৎকার দিতে দিতে ঘরে ঢুকল। জৈতুন বিবি হকচকিয়ে যায়। রান্নাঘরে পাক করছিল সে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে শুধায়, কী রে— এত চিক্কর পাড়স ক্যান?
— মা, ঢাকা শহরে গুলি কইরা মানুষ মারছে—
— কে মারছে?
— পাঞ্জাবি মিলিটারি।
দেখা যায় সাবু খুব উত্তেজিত। মুখ দিয়ে কথা তাড়াতাড়ি বের করে দিতে চাইলেও পারে না। কারণ, শরীর থর থর কাঁপছে। হাতের মুঠি বার বার শক্ত হয়।
— মা, একজন দুজন না। হাজার হাজার মানুষ মারছে।
— কস কী, হাজার হাজার?
— হ, সব মানুষ শহর ছাইড়া চইলা আইতেছে।
ঢাকা শহর থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরবর্তী গাবতলি গ্রাম। কিন্তু যাতায়াতের সুবিধা নেই। তাই সব খবরই দু-দিন বাদে এসে পৌঁছায়। এবার কিন্তু তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। পরদিনই পাওয়া গেছে সব খবর। যারা জওয়ান তারা সোজা হেঁটে হেঁটে বাড়ি পৌঁছেছে। তাই খবর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয় নি। পঁচিশে মার্চের রাত্রে পাঞ্জাবি মিলিটারি ঝাঁপিয়ে পড়ে। জীবন্ত যাকে তাকেই হত্যা করছে।
পরদিন সাবুর সামনে গোটা শহর যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে গেছে জেলা বোডর্ের সড়ক। সেই পথে মানুষ আসতে লাগল। একজন দুজন নয়। হাজার হাজার। একদম পিলপিল পিঁপড়ের সারি। গাবতলি গ্রাম তাদের গন্তব্য নয়। আরও দূরে যাবে তারা। কেউ কুমিল্লা, কেউ নোয়াখালি, কেউ ময়মনসিংহ—একদম গারো পাহাড়ের কাছাকাছি, আরও নানা এলাকায়।
দারুণ রোদ্দুর মাথার উপরে। আর ভির। নিশ্বাসে নিশ্বাসে তাপ বাড়ে। হাঁটার জন্য ক্লান্তি বাড়ে। সব মিলিয়ে জওয়ান মানুষেরাই খাবি খাচ্ছে। মেয়ে, শিশু এবং বেশি বয়সীদের তো কথাই নেই। ক্ষুধার কথা চুলোয় যাক, পিয়াসে ছাতি ফেটে দুতিন জন রাস্তার ধারেই শেষ হয়ে গেল।
জৈতুন বিবি মুড়ি ভেজে দিয়েছিল খুব ভোর-ভোর উঠে। সাবু চাঙারি বোঝাই করে মুড়ি এনে ওদের খাইয়েছে। নিজেরা কীভাবে চলবে সে কথা ভাবে নি। মুড়ি শেষ হলে সে পানি জোগানোর কাজে এগিয়ে গেছে।
এক প্রৌঢ় নারীকে দেখে সে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। পঞ্চাশের বেশি বয়স! কিন্তু কী ফরসা চেহারা! যেন কোনো ধলা পরী। মুখ দেখে বোঝা যায় অনেক হেঁটেছেন, অথচ তাঁর জীবনে হাঁটার অভে্যস নেই। সাবুর কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
— মা, পানি খাবেন?
— দাও বাবা। প্রৌঢ় নারী মুখ খুললেন। গ্লাস আবার ধুয়ে জালা থেকে পানি এগিয়ে দিয়েছিল সাবু। খালি গা। পরনে হাফপ্যান্ট, তাও ময়লা। বড় লজ্জা লাগে সাবুর। প্রৌড়া পানি খেয়ে তৃপ্ত। হাতে চামড়ার উপর নকশা-আঁকা ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। তারপর একটা পাঁচ টাকার নোট সাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, বাবা, তুমি কিছু কিনে খেও।
— এ কী! না-না—
— নাও, বাবা।
— মাফ করবেন। টাকা নিলে আমারে মা বাড়ি থাইকা বাইর কইরা দিব। আমারে কইয়া দিছে, শহরের কত গণ্যমান্য মানুষ যাইব রাস্তা দিয়া! পয়সা দিলে নিবি না। খবরদার। সেই প্রৌঢ়া নারী একটু হাঁফ ছেড়ে বললেন, তোমার মা কিছু বলবেন না।
— আমার মা-রে আপনি চেনেন না। মা কন, বিপদে পইড়া মানুষ বাড়ি আইলে কিছু লওয়া উচিত না। গরিব হইতাম পারি, কিন্তু আমরা জানোয়ার না।
শেষ কথাগুলোর পর নিরুপায় সেই নারী সাবুর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, বাবা, যদি কখনো ঢাকা শহরে যাও, আমাদের বাড়িতে এসো। — আপনাদের বাড়ি?
— লালমাটিয়া ব্লক ডি। আমি মিসেস রহমান।
মিসেস রহমান আবার রাস্তা ধরলেন। সাবু বুঝতে পারে, এই গরমে হাঁটার পক্ষে মোটা শরীর আদৌ আরামের নয়। বেচারা নিরুপায়। শরীর তো আর নিজে তৈরি করেন নি।
তিনি নিমেষে ভিড়ে মিশে গেলেন। ভিড় নয় স্রোত। শহর থেকে যে শুধু গণ্যমান্য মানুষ আসছে, তা নয়। সাধারণ মজুর-মিস্ত্রিরা পর্যন্ত আসছে। সাবু ভাবে, তা হলে শহরেও গরিব আছে, যারা তাদের মতোই কোনো রকমে দিন কাটায়, তাদেরই মতো যাদের ঠিকমতো বিশ্রাম জোটে না, আহার জোটে না, কাপড় জোটে না। এই সময় সাবুর আরো মনে হয়, একবার শহর দেখে এলে হতো। লোক তো শহর পর্যন্ত আছেই। এই জনস্রোত ধরে উজানে ঠেলে গেলেই সেখানে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু তার সাহস হয় না।
একদিন তাদের গ্রামের পাশ দিয়ে গেল আট-নয় জনের একটি পরিবার। সম্ভ্রান্ত জন তারা। সত্তর বছরের বুড়ো তাদের সঙ্গে। তিনটি মাঝ-বয়সী মেয়ে-ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধে্য বয়স— তাকে ধরে ধরে আনছে। সঙ্গে আরো পাঁচ-ছয়টি কুঁচো ছেলেমেয়ে, কেউ আট বছরের বেশি নয়। আর আছে লুঙ্গি পরা হাফ শার্ট পরিহিত জওয়ান একজন। তার চেহারা জানান দেয় বাড়ির চাকর। বুড়ো ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। কখনো মেয়ে তিনটির সাহায্য নেয়, কখনো জওয়ান চাকরের! পাঁচ-ছটি কুঁচো ছেলেমেয়ের খবরদারিও সহজ নয়। কাজেই এই কাফেলা রীতিমতো নাজেহাল। আকাশে তেমনি কাঠফাটা রোদ।
(অসমাপ্ত)